বৃহস্পতিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

দেশটা কি আসলেই বহিঃশক্তির হাতে চলে যাচ্ছে?

দেশ আজ এক চরম সংকটের মুখোমুখি। জেনারেলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশের সীমান্ত পাহারায় দায়িত্বরত বিডিআর তাদের ন্যায্য দাবিতে করেছে বিদ্রোহ। তাদের সে দাবি দাওয়াগুলো দ্রুত মেনে নিয়ে সরকার সমস্যার সমাধান করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তা না করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বল প্রয়োগের কথা বললেন তার ভাষণে।
এদিকে গতকাল বিডিআর জোয়ানরা বলেছে, প্রয়োজনে তারা বিএসএফ সদস্যদের আহ্বান জানানো হবে তথা সীমান্ত খুলে দেয়া হবে। যা এক মারাত্মক হুমকি। জানিনা এই সুযোগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ আবার কী করে বসে। এই ঘটনা আবার বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তাও বা কে জানে?
যাই হোক আল্লাহ আমাদের দেশকে হেফাজত করুন। এই বিদ্রোহের দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক সেটাই কামনা করছি।

সোমবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

কুখ্যাত ম্যাজিট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব

১০ই এপ্রিল ১৯৮৫। কলিকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি মিসেস খাস্তগীরের আদালতে কুরআনের সকল আরবী কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানিয়ে পদ্ম চোপরা ও শীতল সিং একটি রীট আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে ১২ই এপ্রিল’৮৫ বিচারপতি তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারতসহ সারা বিশ্ব প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুসলিম জনতাও এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকে মিছিল সমাবেশের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও সর্বাত্মক প্রতিবাদের উদ্দশ্যে আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহমদকে আহ্বায়ক করে একটি প্রতিবাদ কমিটি গঠন করা হয়। মাওলানা হোসাইন আহমদ এর আহ্বানে ১১ই মে বিকাল ৩ টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে রীট আবেদনের প্রতিবাদে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। ঐ দিন সকালের দিকে প্রতিবাদ কমিটিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডেকে চাপ দিয়ে সভা স্থগিতের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। প্রশাসন নিজ উদ্যোগে সভা স্থগিত করা হয়েছে মর্মে সভা শুরুর কয়েক ঘন্টা আগে থেকে মাইকিং করা শুরু করে। কিন্তু জনতা প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকে। উচ্ছসিত জনতার মিছিল শ্লোগানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ওহেদুজ্জামান মোল্লা ক্ষিপ্ত হয়ে জনতাকে গালি গালাজ করতে থাকে এবং কোনভাবেই এখানে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না বলে জানায়। এ পরিস্থিতিতে মাওলানা ইসারুল হক সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শুধুমাত্র মুনাজাত করেই সভা শেষ করে চলে যাওয়ার অনুমতি চান। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ওহেদুজ্জামান মোল্লা এ আবেদন প্রত্যাখান করলে জনগন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠি চার্জ শুরু করলে জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ম্যাজিস্ট্রেট নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালাতে নির্দেশ দিলে ঘটনা স্থলেই এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে ৮ জন মৃত্যুবরণ করেন।

সেদিন সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণেই সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম হয়। পুলিশের নৃশংসতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, গুরুতর আহতদের নিয়ে রাজশাহী হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যখন থানার সামনে দিয়ে একটি বাস যাচ্ছিল তখন সেই বাসেও তারা হামলা চালায় এবং গুলি করে একজনকে হত্যা করে এবং হেলপারসহ অনেককে আহত করে।

যদিও বিশ্ব মুসলিমের প্রতিবাদের মুখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মামলাটি খারিজের জন্য এটর্নী জেনারেলকে নির্দেশ দেয়। ১৩ই মে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি. বসাকের আদালতে স্থানান্তরিত হলে মামলাটি তিনি খারিজ করে দেন।

কুরআন বিদ্বেষী এবং খুনি কুখ্যাত ম্যাজিট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব। সরকারের ইসলামবিরোধী চরিত্র এই নিয়োগের মাধ্যমে পূর্ণরূপ পেল।

মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

মন ভালো নেই

মনটা ভালো নেই। কয়েকদিন ধরে কেম যেন লাগছে। মনে হয় বেঁচে থাকার মধ্যে কোন স্বার্থকতা নেই। বার বার ঘুরে ফিরে মৃত্যুর পরবর্তী কথা মনে হচ্ছে। মনে হয় কাজ করে আর লাভই বা কী? বাঁচবই বা আর কদিন? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বুঝি যে কোন ধরণের দুশ্চিন্তা কিংবা আঘাত থেকে হতে পারে এধরনের রোগ। আরও জানি এটা একটা মানসিক রোগ ছাড়া আর কছিুই নয়। কিন্তু তারপরও কেন জানি স্বাভাবিক হতে পারছি না।

মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

সেনাপ্রধানের স্বপ্ন দর্শন

আজকের একটি পত্রিকায় দেখতে পেলাম, আমাদের মাননীয় সেনাপ্রধান আমাদের প্রিয় নবীজিকে দু'দু'বার স্বপ্নে দেখেছেন। শুধু তাই নয়, তাকে নাকি কী নির্দেশনাও দিয়েছিলেন তিঁনি। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এমন একজন সেনা প্রধান পেয়েছি যিনি রাসুল (সা.) কে স্বপ্নে দেখেছেন। এমন ভাগ্য আর কোন জাতির আছে? সালাম, জেনারেল সালাম। আপনার চাকরির মেয়াদ আরও আজীবন বাড়ুক। আমরা এমন একজন সেনা প্রধানকে মিস করতে চাইনা।
বর্তমান সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যেহেতু সংসদে আপনাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, সেহেতু দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাপ্রধানের দায়িত্বের মেয়াদ আজীবন বাড়িয়ে দিন।
স্বপ্ন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

রবিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি

মুহাম্মাদ বাকীবিল্লাহ

বাংলাদেশে ক্ষমতার সাম্প্রতিক পালাবদলের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই এখন আলোচনা চলছে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নিয়ে । বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন দেশের সাংবিধানিক প্রধান। তার নামেই দেশের সকল নির্বাহী কার্যাদি সম্পাদিত হয়। দেশের সংবিধান অনুসারে পার্লামেন্টের সদস্যদের দ্বারা তিনি ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দেশের প্রতীকি প্রধান হলেও তার কাজ একবারে কম নয়। তিনি তার বিবেচনায় অধিকাংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন লাভে সক্ষম একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নিয়োগ দেন।এছাড়া এটর্নি জেনারেল, নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, পিএসসিসহ সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের নিয়োগ দেন। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিভাগেরও প্রধান তিনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বিচারসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতাও রয়েছে। তিনি যে কোনো আদালত কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড হ্রাস, স্থগিত কিংবা মওকুফ করতে পারেন। সংসদে পাশকৃত বিল তার সম্মতি ব্যতিত আইনে পরিণত হতে পারে না।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ’র পর সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে আলোচিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের নাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের নাম ঘোষণা করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যখন কারাগারে বন্দী তখন এই প্রবীণ নেতার অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার পুরস্কার হিসেবেই প্রেসিডেন্ট পদটি পেতে যাচ্ছেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি হতে যাচ্ছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৮তম রাষ্ট্রপতি।
আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জিল্লুর রহমান বরাবরের মতো এবারও কিশোরগঞ্জ-৬ সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। পেশায় আইনজীবী দলের এ সিনিয়র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দুই দফায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার স্ত্রী আইভি রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তিনি মারা যান। জিল্লুর রহমান বিগত দুবছর যাবৎ সরকারের প্ররোচনায় দল ভাঙ্গার অসংখ্য প্রচেষ্টা, তথাকথিত সংস্কার প্রচেষ্টার মুখে দলের ঐক্য ও পুর্ন সাংগঠনিক শক্তি সংহত করে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (১) দফার বিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে উক্ত পদ শূন্য হলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী নব্বই হতে ষাট দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেই সংসদের দ্বারা তিনি নির্বাচিত হয়েছেন সেই সংসদের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতি কার্যকাল শেষ হলে সংসদের পরবর্তী সাধারন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত শূন্য পদ পূর্ণ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না এবং সাধারন নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির শূন্য পদ পূর্ণ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বর্তমানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পরিচালনার জন্য “রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১” এবং “রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বিধিমালা, ১৯৯১” রয়েছে। ১৯৯১ সালের পূর্বে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার উপাধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। তার কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দালনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৯৪৯ সালে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ছাত্রনেতা । একই সাথে আওয়ামী লীগের উচ্চপদেও আসীন হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল থাকেন।
তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তুখোড় বক্তৃতা প্রদানের মতা। একজন বাস্তবাদী রাজনীতিক হিসেবে তিনি তৎকালীন বঙ্গদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল বর্ধিত প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন যার কারণে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পে পরিণত হন। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি একসময় ছয় দফা পরিকল্পনা পেশ করেন, যাকে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি ভারত সরকারের সাথে মিলে এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করলেও তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়নি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। বরং এ নিয়ে আলোচনার নামে চলে নানা তালবাহানা।
পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলি ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৭১ সনের মার্চ ২৫ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। একই রাতে তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে ৯ মাসের রক্তয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী বছর ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকায় ফিরে তিনি দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিছুদিন পরে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রচণ্ড দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মোকাবেলায় তিনি সফল হতে পারেন নি। ফলে তিনি তার সম্মোহনী নেতৃত্বকে পূঁজি করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি সকল দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাকশাল কায়েম করেন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। এসময় তিনি তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র কর্মসূচীও প্রদান করেন। কিন্তু তার এসব কাজে তিনি ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। এমন কি নিজের দলের নেতাদের সাথেও তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। দেশে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ সব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে একদল উচ্চাভিলাসী সামরিক কর্মকর্তা তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকলেও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকার কারণে নজরুল ইসলামকেই মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক নির্দেশনা প্রদান করতে হয়েছিল।
১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার যমোদল দামপাড়ায় তার জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৪৭ সালে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়। এক সময় তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৯ সালে তিনি কর বিভাগে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্তু ১৯৫১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ময়মনসিংহ আনেন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি আইন ব্যবসায় শুরু করেন। কর্মজীবনে তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। স্বাধীনতার পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর তিনিসহ তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী বন্দী হন। ঐ বছরই জেলখানায় তার অপর তিন সহকর্মীসহ তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার নাগরবাড়ির এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন এবং পরে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং ১৯৬১ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯ ৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। একাত্তরের মার্চ মাসে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”।
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে ৬৬ বছর বয়সে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে লন্ডনে মারা যান।

মোহাম্মদউল্লাহ
বাংলাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ’র জন্ম ১৯২১ সালের ২১ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ইতিহাস বিভাগে স্নাতক ডিগ্রী এবং ১৯৪৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫০ সাল থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করলে তৎকালীন গণপরিষদের স্পিকার হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের ২৪ জানুয়ারী দেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২৭ জানুয়ারী তিনি শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ
দেশের ৫ম রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯১৮ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার দাসপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৪২ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম মহাসচিব।
তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনিত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রিয় সরকার ১৯৩৫ সালের আর্টিকেল ৯২-এ ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিলে ১৯৫৪ সালে অন্যান্য নেতাদের মতো তাকেও কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্ত হয়ে আবার সংসদে যুক্তফ্রন্টের চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করার পর তিনি আবার বন্দি হন। মুক্ত হওয়ার পর ১৯৬৬ সালে ছয়-দফার সমর্থন করায় তাকে আবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারে তিনি পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে তিনি বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকারি কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার পর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এই পদে তিনি মাত্র ৮৩ দিন ছিলেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি ইনডেমিনিটি বিল পাশ করেন। তিনি "জয় বাংলা" স্লোগান পরিবর্তন করে এর স্থলে "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" চালু করেন। এই সময় তিনি "বাংলাদেশ বেতার" নাম পরিবর্তন করে "রেডিও বাংলাদেশ" করেন। তার শাসনামলে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী এবং এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে ঢাক কেন্দ্রীয় কারাগারে (৩ নভেম্বর) হত্যা করা হয়। মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর সেনা বিদ্রোহের এক পর্যায়ে অপসারিত হন।
১৯৭৬ সালে মোশতাক আহমেদ ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২ টি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এবং আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। ৫ মার্চ ১৯৯৬ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম
বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। তিনি ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি।
আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বর্তমান রংপুর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন ১৯১৬ সালে। তিনি রংপুর জেলা স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং পরবর্তীতে কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়ণ করেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেন ও ইউনিভার্সিটি ল' কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন।
কলকাতা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পর ১৯৪৭ সালে সায়েম ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন। বাঙ্গালি রাজনীতিবিদ এ.কে. ফজলুল হকের সাথেও তিনি কাজ করেন। একসময় তিনি ঢাকা হাই কোর্ট বার এসোসিয়েশনের নির্বাচিত মহাসচিব ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৬২ সালের ৩ জুলাই তিনি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিচাপতি সায়েমকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি দেশের প্রথম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ও ৬ নভেম্বর এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিচাপতি সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি হয়ে তিনি সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল তিনি দূর্বল স্বাস্থ্যের কারণে জিয়াউর রহমানের হাতে রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিয়ে অবসরগ্রহণ করেন।
তিনি অবসর জীবনে রচনা করেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘At Bangabhaban : Last Phase' (১৯৮৮)। এ বইটিতে ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

শহীদ জিয়াউর রহমান
বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার বাগবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা মনসুর রহমান কলকাতায় এক সরকারি দফতরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জিয়াউর রহমান বগুড়া ও কলকাতার বিভিন্ন স্কুলে শৈশবে অধ্যয়ন করেন ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তার পিতা করাচিতে বদলি হলে সেখানকার একাডেমি স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচি’র ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন।
১৯৫৫ সালে জিয়াউর রহমারন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। পরবর্তীতে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য বিভিন্ন খেতাব লাভ করেন। বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭০ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি হত্যার অভিযানে লিপ্ত হলে তাদের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী হন এবং রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে চলে যায়। এ সময় জনগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহুর্তে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহীনির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ২৬ মার্চ রাতে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তিনি সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বাধীনতার পর ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তাকে সেনাবাহিনীর বিগ্রেড কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয়। এরপর বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে ১৯৭৫ সালে চীফ অফ আর্মি স্টাফ পদ লাভ করেন। ঐ বছর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর সংঘটিত ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর তাকে প্রধান আইন প্রশাসক নিয়োগ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে রাষ্ট্রপতি সায়েম পদত্যাগ করলে তার পদে অধিষ্ঠিত হন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্টিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এক সরকারি ঘোষণার দ্বারা সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানের মুখবন্ধে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেন। তিনি জাতি-বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্বারোপ করে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ তত্ত্ব প্রদান করেন এবং তা জনপ্রিয় করে তোলেন। তাছাড়া তিনি বহুদলীয় রাজনীতির পুনপ্রবর্তন ও গণমাধ্যমকে হারানো স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেন। দেশের স্বার্থে বিভিন্ন নীতিগ্রহণ করে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার নেতৃত্বে গঠিত হয় বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। এর পর সংবিধানের ৫ম সংশোধনী আইন বলে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে তিনি নিহত হন।

বিচারপতি আব্দুস সাত্তার
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসময়ে তার বয়স ছিল ৭৬ বছর। পরে তিনি ১৯৮১ সালের ২১ সেপেম্বর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৬% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার শাসনকালে সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ১৯৮২ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তার জায়গায় সামরিক আইন জারীর মাধ্যমে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দখল করেন।

এ এফ এম আহসান উদ্দিন চৌধুরী
ময়মনসিংহ জেলার বোকাইনগরে ১৯১৫ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এ এফএম আহসান উদ্দিন চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বিএল ডিগ্রি লাভ করে ১৯৪২ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ঢাকা হাইকোর্টের এবং ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন আহসান উদ্দিন। ১৯৭৭ সালে তিনি চাকরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। মাত্র কয়েকদিন পরে তথা ২৭ মার্চ জেনারেল এরশাদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত করেন। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর এরশাদের চাপে পদত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন সামরিক শাসক এরশাদ।
বিচারপতি আহসান উদ্দিন বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িত ছিলেন। ২০০১ সালের ৩০ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
লেফটেনেন্ট জেনারেল (অবঃ) হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি, এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বর্তমানে জাতীয় পার্টি (এরশাদ)-এর চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদ সদস্য। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে তিনি রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রংপুর জেলায় শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬০-১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে অ্যাডজুটান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪ বিগ্রেডের মেজর ছিলেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-১৯৭০ সালে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট ও ১৯৭১-১৯৭২ সালে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় এরশাদ ছুটিতে রংপুর ছিলেন। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তিনি পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিরা যখন ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসে তখন তিনিও ফিরে আসেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সময় আগ্রা ক্যান্টনমেন্টে স্টাফ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুটান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে তিনি কর্নেল ও ১৯৭৫ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীতে বিগ্রেডিয়ার পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালেই তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান ও Deputy Chief of Army Staff হিসেবে নিয়োগ পান।
৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর, এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাশ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে মতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি রাষ্ট্র মতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। সাধারণ নির্বাচনে তার দল সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করে। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তিনি ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর এই সংসদ বাতিল করেন। ১৯৮৮ সালের সাধারন নির্বাচন সকল দল বয়কট করে। এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগনকে সাথে নিয়ে সকল বিরোধী দল আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে মতা থেকে অপসারণ করে।
মতা হারানোর পর জেনারেল এরশাদ গ্রেফতার হন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি জেল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। বি.এন.পি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পরে, যার মধ্যে একটি অংশের তিনি এখনো চেয়ারম্যান। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্বিতা করে ৩টিতেই বিজয়ী হয়েছেন। তার দলও আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে।

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ
বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমাল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম তালুকদার রিসাত আহমেদ। শাহাবুদ্দিনের শিক্ষা জীবন কাটে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ে যেখান থেকে তিনি ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তদানিন্তন পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রথমে লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমী এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনে উচতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
শাহাবুদ্দিন আহমেদের কর্মজীবনের সূচনা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। এর পর তিনি গোপালগঞ্জ ও নাটোরের মহকুমা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সহকারী জেলা প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পর ১৯৬০ সালে তিনি প্রশাসন হতে বিচার বিভাগে বদলী হন। তিনি ঢাকা ও বরিশালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি হাই কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আবদুর রহমান বিশ্বাস
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯২৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর বরিশালের শায়েস্তাবাদ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে বরিশালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রিও লাভ করেন।
প্রথমে আবদুর রহমান বিশ্বাস স্থানীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সভাপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাজের জন্য সরকার ১৯৫৮ সালে তাকে সেচ্ছাসেবি সমাজ কর্মি হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। ৫২ ভাষা আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি সংসদ সচিব হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি জাতিসঙ্ঘের ২২তম সাধারণ সভায় অংশ করেন। ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালে তিনি বরিশাল বার
‌অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আবদুর রহমান বিশ্বাস সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯-৮০ সময়ে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় পাট মন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৮১-৮২ সালে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৯১ এর ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৪ এপ্রিল ১৯৯১ সালে তিনি সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। দেশে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হবার পর ১৯৯১ এর ৮ অক্টোবর দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি দেশের এক সামরিক ক্যু প্রতিহত করেন। ১৯৯৬ সালের ৮ অক্টোবর তার রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদ শেষ হলে তিনি অবসর নেন।

প্রফেসর একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
প্রফেসর একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী কুমিল্লার মুনেফ বাড়ি এলাকায় তার মামা বাড়িতে ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এপ্রিল ১৫, ১৯৭৯ সালে তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এসময় তিনি স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় আসার পর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। এর কিছুদিন পর ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
২০০২ সালের ২১ জুন দলের অভ্যন্তরের অন্যান্য নেতাদের চাপে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি এর আগের মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার মাজারে না গিয়ে তার প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করেন। এরপর তিনি বিএনপি ত্যাগ করেন এবং তার পুত্র বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মাহি বি চৌধুরিকে সাথে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল বিকল্প ধারা গঠন করেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হওয়ায় দলের সংবিধান অনুসারে তিনি বিকল্প ধারার চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

ব্যারিস্টার জমিরুদ্দিন সরকার
জমিরউদ্দিন সরকার ১৯৩১ সালের ১ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার তেতুঁলিয়া থানার নয়াবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মৌলভী মুহম্মদ আজিজ বক্স একজন জোতদার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয় থেকে এমএ ও এলএলবি পাশ করেন। পরে লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এক কন্যা ও দুই পুত্রের জনক।
জমিরউদ্দিন সরকার বাংলাদেশের ৮ম জাতীয় সংসদের স্পীকার ছিলেন। তিনি দুইবার বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার মোট ৪ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এবারের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এর আগে তিনি ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেশ কিছু দিন দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করার পর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক বিএনপি সরকারে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০-৮২ সময়কালে তিনি প্রথমে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে তিনি ভূমি, শিক্ষা এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত স্বল্পকালীন বিএনপি সরকারে তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৫ সালে ছাত্র থাকা অবস্থায় তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। পরে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের সমর্থক ছিলেন। ১৯৭১ সালে হাইকোর্টে আইনজীবীদের যে গ্রুপটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন তাদের একজন। আইন পেশায় সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাকে পাঁচবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান। দল গঠনের প্রথম পর্যায়ে জিয়াউর রহমান জাগদল গঠন করলে তিনি তাতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল-এর ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সারির সদস্য। পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। প্রথমবার গণপূর্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বর্তমান সংসদ ভবনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। গত চার দশকে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ সফর করেছেন এবং আন্তর্জাতিক বহু আইন সম্মেলন ও সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছেন।

ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার নারায়ণগঞ্জ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভি মুহাম্মদ ইব্রাহিম। ১৯৪৮ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ মুন্সিগঞ্জ উচ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৫০ সালে মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ ও ১৯৫২ সালে যথাক্রমে বি.এস.সি ও এম.এস.সি পাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকোনিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে যথাক্রমে এম.এস. ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ১৯৬৮-৬৯ ও ১৯৭৬-৭৯-এ দুই মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ নাগাদ পর পর দুই বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন নির্বাচিত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং বোর্ড অফ এডভান স্টাডিস এর সদস্য ছিলেন।
এছাড়াও অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধ্যায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তখন তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-৯৩ সময়ে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ও ১৯৯৫-৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার আগ পর্যন্ত তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর দেশের এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি এই পদ ত্যাগ করেন এবং তার পরদিন বাংলাদেশ ব্যাংক এর সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরিস্থিতির কারণে তাকেই এ পদে বহাল থাকতে হয়।

কারেন্ট ইস্যু : সর্বশেষ সংযোজন

Current Issue Forum Headline Animator

Current Issue Forum